হরতাল হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকার পক্ষও হরতাল কর্মসূচি দিয়ে থাকে। হরতালের সময় এ আন্দোলন সমর্থনকারীরা সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, অফিস-আদালত বন্ধ রাখে। তবে জরুরী কাজে ব্যবহৃত পরিষেবা গুলো হরতালের আওতা মুক্ত থাকে।
হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ; যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
হরতাল সাধারণত কোনো একটা দাবি আদায় করার বা এর গুরুত্ব বোঝাতে আহ্বান করা হয়। শান্তিপূর্ণ হরতালের মূল কার্যক্রম হয়ে থাকে প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ। অর্থাৎ হরতাল সমর্থকরা রাজপথে বেরিয়ে একত্র হয়ে উচ্চস্বরে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানান দিয়ে থাকেন। কিন্তু কখনও কখনও এই পদ্ধতির ব্যবহার করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া, কিংবা আইনবহির্ভুত কাজে নেমে যাওয়া হরতালকে শান্তিপূর্ণ রাখে না। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হরতাল সমর্থকদের বাধা দিতে বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকেন। এধরনের দাঙ্গা মোকাবেলায় পুলিশের বিশেষ দাঙ্গা বাহিনী নিয়োজিত হয়ে থাকে।
বিশ্বজুড়ে হরতাল-বনধ একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভাষা হলেও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এটা একটি উদ্বেগ, আতঙ্ক আর পেট্রোল বোমায় ঝলসানোর প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান, উচ্চ আদালত এবং আইনের বিভিন্ন ধারা দেখিয়ে ‘মৌলিক অধিকার’ নাম দিয়ে হরতালের ডাক দেওয়া হয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে হরতাল
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার পালন করা যাবে’।
মৌলিক অধিকারের কথা বলে হরতাল ডাকা হলেও বর্তমান সময়ের হরতালে দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারা অমান্য করা হয়। যেমন সহিংসতা ও পিকেটিং ১৪১ ও ১৪৬ ধারা অনুসারে অপরাধ।
তবে হরতালের সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, সন্ত্রাস বিরোধী আইন-১৯৯২ ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও হরতালের সহিংতায় যারা গ্রেফতার হয় তাদেরকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে মুক্তি দাবি করা হয়।
প্রস্তাবনায় হরতাল নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায় উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী রায়ে বলেন, ‘(ভাবানুবাদ) কোনো প্রকার ভয়-ভীতি না দেখিয়ে হরতাল ডাকা একটি বৈধ কর্মকাণ্ড এবং সেটা প্রতিবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) (এ) সংরক্ষিত। এখানে ভয়-ভীতি না দেখিয়ে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি’।
২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মজিবুল হক চুন্নু একটি হরতাল নিয়ন্ত্রণ আইন প্রস্তাব আকারে পেশ করেন। কিন্তু তা পাস হয়নি।
হরতালের ইতিহাস
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন এর বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারতে প্রথম বয়কট কর্মসূচি পালন করা হয়। পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের মধ্যে সত্যাগ্রহ, অনশন, বয়কট, মার্চপাস্ট, বর্জন, অসহযোগ, অবরোধ, মিছিল ইত্যাদি ছিল। এসব আন্দোলন ছিলো অহিংস। এসব আন্দোলনের পরে আসে বনধ বা হরতালের মতো কর্মসূচি।
একটি প্রতিবেদন মতে দেখা যায়, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে হরতাল হয়েছে ৩ দিন, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৭ দিন, ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৭ দিন এবং ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪৬ দিন।
উল্লেখ, এখন হরতাল মানে শহরের যেকোনো স্থানে সংঘাত, গাড়ি ভাংচুর, পেট্রোল বোমা, ককটেল, যেকোনো স্থানে বাসে-গাড়িতে আগুন, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলা, গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি।