বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। সড়কে মৃত্যু যেন কিছুতেই থামছে না। আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় এবং আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একই রকম কারণে বারবার ঘটতে থাকে, যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না; ফলে সেগুলো আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, যা মূলত ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত অবহেলার ফল। তাই অবহেলাজনিত মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা মোটেও উচিত নয়।
দেশে বৈধ গাড়িচালকের কাছ থেকে দ্বিগুণ রেজিস্ট্রেশনকৃত যানবাহন আছে। চালকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। যানবাহনের সংখ্যানুপাতে পর্যাপ্ত সড়ক নেই। যতটুকু আছে তার একটা বড় অংশই বিভিন্ন উপায়ে দখলকৃত। এছাড়া এদেশের সড়কের মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি বসানো থাকে। শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত নসিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরযুক্ত রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশা থেকে শুরু করে সিএনজি, ইজিবাইক, লেগুনা এগুলো কোনো টেকসই ও কার্যকর পরিবহন হিসেবে বিবেচ্য হয় না। অনেকেই এগুলোকে যোগাযোগের নিকৃষ্ট পরিবহন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। একইভাবে রিকশাও কোনো কার্যকর যানবাহন নয়। কোনো সভ্য ও উন্নত দেশে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জীবিকা নির্বাহের জন্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যা দৃষ্টিকটু ও অশোভন। একসময় হয়তো এর প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন এর বিকল্প পরিবহন গড়ে তোলার সময় হয়েছে। রিকশাকে আমাদের জাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে। রিকশার কারণে ঢাকা শহর জঞ্জালের শহরে পরিণত হয়েছে। তবে এসব পরিবহনের পক্ষে অনেকেই যুক্তি দেখাবে। বিশেষ করে এসব যানবাহন চালু হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
পড়ুন: দেশের সেরা ড্রাইভিং স্কুল সমূহ
গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোয় এগুলোর চলাচল নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা না মেনে চলার কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেকের প্রাণহানির কারণ ঘটছে। এসব পরিবহনের অধিকাংশ চালকই প্রশিক্ষিত নন। ফলে তারা যান চলাচলের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন এবং নিয়ম-কানুন না মেনে চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পড়ার পাশাপাশি অন্য যানবাহনের জন্য দুর্ঘটনার কারণ হন। একইভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয়ে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি আরোপের সময় হয়েছে। এর পাশাপাশি মোটরসাইকেলের সংখ্যা ও ব্যবহারও কমাতে হবে। অসংখ্য অব্যবস্থাপনার মধ্যে উল্লিখিত কিছু সুনির্দিষ্ট ও চিহ্নিত কারণের ফলে সড়কে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং গুরুতরভাবে আহত হচ্ছে। যেহেতু কিছু সুনির্দিষ্ট এই সড়কে লাশের মিছিল ভারী হচ্ছে, সেহেতু দুর্ঘটনা না বলে এগুলোকে হত্যাকাণ্ড বলাটাই উচিত।
যেকোনো একটা প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সাধারণত দুটা পক্ষ কাজ করে; প্রথমটি পরিচালনা করে বা দিকনির্দেশনা দেয় এবং অপরটি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যায়। আমাদের দেশের সাধারণ চালকরাই হলো দ্বিতীয় পক্ষের, যারা পরিশ্রম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু যারা তাদের মনিটরিং করবে, প্রশাসনের সেই কর্তাব্যক্তিরা কি আদৌ তাদের ঠিক দায়িত্বটুকু পালন করছে? যেকোনো কাজের একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সড়কের অব্যবস্থাপনা নিরসনের দায়িত্বে যারা রয়েছে, তারা হয়তো এখনও কোনো লক্ষ্যই নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে সড়কের চিহ্নিত অব্যবস্থাপনা সমাধান করতে না পারায় দায়িত্বশীলদেরই এসব হত্যাকাণ্ডের দায়ভার নিতে হবে। পুরো সড়ক ব্যবস্থাটাই অপরিকল্পিত। ফলে ছাত্র-জনতা বিভিন্ন সময় সড়কব্যবস্থার পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করেছে। মেয়র, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছেও উপস্থাপিত হয়েছে ওইসব আন্দোলনের দাবি-দাওয়া। বর্তমানে সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্বই পাচ্ছে না, যে কারণে দুর্ঘটনা কমছে না।
প্রথম প্রকাশ: শেয়ার বিজ